সার্ভার কি? সহজ ভাষায় জানুন ওয়েব সার্ভার কিভাবে কাজ করে

আপনি যখন কোন ওয়েবসাইট খুলেন, আপনার ফোন বা কম্পিউটারে সেই তথ্য কিভাবে আসে? আপনি যখন ইউটিউবে ভিডিও দেখেন, সেই ভিডিও কোথা থেকে আসে? এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর একটি শব্দে লুকিয়ে আছে: সার্ভার।

ইন্টারনেটের এই অদৃশ্য নায়কদের বিষয়ে আজ আমরা জানব। সার্ভার কি, এরা কিভাবে কাজ করে, এবং কেন আমাদের ডিজিটাল জীবনে এরা এতটা গুরুত্বপূর্ণ।

সার্ভার আসলে কী? (What is a Server Really?)

সবচেয়ে সহজভাবে বললে, সার্ভার হলো একটি বিশেষ ধরনের শক্তিশালী কম্পিউটার বা একটি সফটওয়্যার প্রোগ্রাম যা নেটওয়ার্কে থাকা অন্যান্য কম্পিউটার বা ডিভাইসকে (যাদের ক্লায়েন্ট বলা হয়) বিভিন্ন সেবা (Service) বা ডেটা প্রদান করে।

সার্ভারগুলো সাধারণত সাধারণ কম্পিউটারের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়, কারণ এদেরকে একই সময়ে অনেক ব্যবহারকারীর অনুরোধ সামলাতে হয় এবং ২৪/৭ চালু থাকতে হয়।

ক্লায়েন্ট-সার্ভার মডেল: যেভাবে চলে কথোপকথন (Client-Server Model: How the Conversation Works)

ইন্টারনেটের বেশিরভাগ কার্যক্রমই ক্লায়েন্ট-সার্ভার মডেল অনুসরণ করে। এই মডেলে:

1. ক্লায়েন্ট (Client): এটি হলো আপনার ডিভাইস (যেমন: ল্যাপটপ, স্মার্টফোন, ট্যাবলেট) এবং এতে চলা সফটওয়্যার (যেমন: ওয়েব ব্রাউজার – ক্রোম, ফায়ারফক্স)। ক্লায়েন্ট কোনো তথ্য বা সেবার জন্য সার্ভারের কাছে অনুরোধ পাঠায়।
2. সার্ভার (Server): এটি হলো সেই শক্তিশালী কম্পিউটার বা সফটওয়্যার যা ক্লায়েন্টের অনুরোধ গ্রহণ করে, প্রসেস করে এবং প্রয়োজনীয় ডেটা বা সেবা ক্লায়েন্টের কাছে ফেরত পাঠায়।

একটি বাস্তব উদাহরণ

সার্ভারকে একটি রেস্টুরেন্টের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। রেস্টুরেন্টে:

• আপনি (ক্লায়েন্ট) মেনু থেকে খাবার অর্ডার করেন (request)
• ওয়েটার আপনার অর্ডার রান্নাঘরে নিয়ে যায়
• শেফ খাবার তৈরি করে
• ওয়েটার আপনার টেবিলে খাবার সার্ভ করে (response)

ঠিক একইভাবে, ইন্টারনেটে:

• আপনার ব্রাউজার (ক্লায়েন্ট) ওয়েবসাইটের জন্য অনুরোধ পাঠায়
• ওয়েব সার্ভার সেই অনুরোধ গ্রহণ করে
• সার্ভার প্রয়োজনীয় ডাটা প্রস্তুত করে
• সার্ভার আপনার ব্রাউজারে ওয়েবসাইটের কন্টেন্ট পাঠিয়ে দেয়

যখন আপনি কোনো ওয়েবসাইটের ঠিকানা (যেমন www.google.com) আপনার ব্রাউজারে লেখেন, তখন আপনার ব্রাউজার (ক্লায়েন্ট) ইন্টারনেটের মাধ্যমে গুগল এর সার্ভারের কাছে একটি Request পাঠায়। গুগল এর সার্ভার সেই Request পেয়ে ওয়েবসাইটটির ডেটা (HTML, CSS, ছবি ইত্যাদি) আপনার ব্রাউজারে একটি Response হিসেবে ফেরত পাঠায়। আপনার ব্রাউজার তখন সেই ডেটা ব্যবহার করে ওয়েবসাইটটি আপনার স্ক্রিনে প্রদর্শন করে।

সার্ভারের রকমফের: বিভিন্ন কাজের জন্য বিভিন্ন সার্ভার (Types of Servers)

বিভিন্ন ধরনের কাজের জন্য বিভিন্ন প্রকার সার্ভার ব্যবহার করা হয়। কিছু পরিচিত সার্ভারের ধরণ হলো:

• ওয়েব সার্ভার (Web Server): এদের মূল কাজ হলো ওয়েবসাইট হোস্ট করা এবং ব্যবহারকারীদের ব্রাউজারে ওয়েবপেজ দেখানো। যখন আপনি কোনো ওয়েবসাইটে যান, আপনি আসলে একটি ওয়েব সার্ভার এর সাথে যোগাযোগ করছেন। এরা HTTP (Hypertext Transfer Protocol) বা HTTPS প্রোটোকল ব্যবহার করে ডেটা আদান-প্রদান করে।
• ডেটাবেস সার্ভার (Database Server): এরা বিশাল পরিমাণ ডেটা সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনা এবং পুনরুদ্ধার করার কাজ করে। যেমন, ফেসবুক আপনার প্রোফাইল তথ্য, বন্ধুদের তালিকা, পোস্ট ইত্যাদি একটি ডেটাবেস সার্ভার-এ সংরক্ষণ করে। অনলাইন শপিং সাইটের পণ্যের তথ্যও ডেটাবেস সার্ভারে থাকে।
• ফাইল সার্ভার (File Server): একটি নেটওয়ার্কের মধ্যে ফাইল সংরক্ষণ এবং শেয়ার করার জন্য ফাইল সার্ভার ব্যবহৃত হয়। অফিসের নেটওয়ার্কে বা ক্লাউড স্টোরেজ (যেমন Google Drive, Dropbox, FTP সার্ভার, NAS (Network Attached Storage) ) ফাইল সার্ভারের উদাহরণ।
• ইমেইল সার্ভার (Mail Server): ইমেইল পাঠানো, গ্রহণ করা এবং সংরক্ষণ করার জন্য এই সার্ভারগুলো কাজ করে (যেমন Gmail, Outlook এর সার্ভার)।
• গেম সার্ভার (Game Server): অনলাইন মাল্টিপ্লেয়ার গেম খেলার সময় খেলোয়াড়দের মধ্যে সংযোগ স্থাপন এবং গেমের ডেটা পরিচালনা করার জন্য গেম সার্ভার ব্যবহৃত হয়।

ওয়েব সার্ভার কিভাবে কাজ করে? (How Does a Web Server Work?)

আসুন, একটি ওয়েব সার্ভার কিভাবে কাজ করে তা ধাপে ধাপে দেখি:

1. অনুরোধ প্রেরণ (Sending the Request): আপনি আপনার ওয়েব ব্রাউজারে একটি ওয়েবসাইটের ঠিকানা (URL – Uniform Resource Locator) টাইপ করে এন্টার চাপেন।
2. ডোমেইন নেম সিস্টেম (DNS): আপনার ব্রাউজার প্রথমে DNS সার্ভারের সাহায্য নিয়ে ওই ওয়েবসাইটের নামের (ডোমেইন নেম)对应的 IP অ্যাড্রেস (একটি ইউনিক সাংখ্যিক ঠিকানা, যেমন 172.217.160.142) খুঁজে বের করে।
3. সংযোগ স্থাপন ও HTTP Request: ব্রাউজারটি খুঁজে পাওয়া IP অ্যাড্রেসের ওয়েব সার্ভার-এর সাথে একটি ইন্টারনেট সংযোগ স্থাপন করে এবং একটি HTTP Request পাঠায়। এই রিকোয়েস্টে বলা থাকে যে কোন নির্দিষ্ট পেজ বা ফাইলটি দরকার।
4. সার্ভারের কাজ (Server Processing): ওয়েব সার্ভার সফটওয়্যার (যেমন Apache বা Nginx) সেই Request গ্রহণ করে। এটি তখন সার্ভারের হার্ডডিস্ক থেকে অনুরোধ করা ফাইলগুলো (যেমন HTML ডকুমেন্ট, ছবি, CSS স্টাইলশীট, JavaScript ফাইল) খুঁজে বের করে। যদি ওয়েবপেজটি ডাইনামিক হয় (যেমন ব্যবহারকারীর লগইন তথ্য অনুযায়ী পরিবর্তন হয়), সার্ভার হয়তো একটি স্ক্রিপ্টিং ল্যাঙ্গুয়েজ (যেমন PHP, Python) এবং ডেটাবেস ব্যবহার করে পেজটি তৈরি করবে।
5. HTTP Response: সার্ভার প্রয়োজনীয় ফাইল বা তৈরি করা ডেটা একটি HTTP Response-এর মাধ্যমে ব্রাউজারের কাছে ফেরত পাঠায়। এই রেসপন্সে স্ট্যাটাস কোডও থাকে (যেমন 200 OK মানে সব ঠিক আছে, 404 Not Found মানে ফাইলটি খুঁজে পাওয়া যায়নি)।
6. পেজ প্রদর্শন (Rendering the Page): আপনার ব্রাউজার সার্ভারের কাছ থেকে পাওয়া ফাইলগুলো (HTML, CSS, JavaScript) গ্রহণ করে এবং সেগুলোকে সমন্বিত করে একটি পূর্ণাঙ্গ ওয়েবপেজ হিসেবে আপনার স্ক্রিনে প্রদর্শন করে।

এই পুরো প্রক্রিয়াটি সাধারণত কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সম্পন্ন হয়ে যায়!

জনপ্রিয় কিছু ওয়েব সার্ভার ও প্রযুক্তি (Some Popular Web Servers and Technologies)

বর্তমানে অনেক ধরণের ওয়েব সার্ভার সফটওয়্যার এবং সম্পর্কিত প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়। এদের মধ্যে কয়েকটি জনপ্রিয় হলো:

• Apache HTTP Server: এটি বিশ্বের অন্যতম পুরোনো এবং বহুল ব্যবহৃত ওপেন সোর্স ওয়েব সার্ভার। এর নির্ভরযোগ্যতা এবং নমনীয়তার জন্য এটি পরিচিত।
• Nginx (Engine-X): এটি আরেকটি জনপ্রিয় ওপেন সোর্স ওয়েব সার্ভার। এটি উচ্চ পারফরম্যান্স এবং একই সাথে অনেক বেশি কানেকশন সামলানোর ক্ষমতার জন্য বিখ্যাত। এটি প্রায়শই রিভার্স প্রক্সি, লোড ব্যালান্সার এবং HTTP ক্যাশ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।
• Microsoft IIS (Internet Information Services): এটি মাইক্রোসফটের তৈরি ওয়েব সার্ভার যা উইন্ডোজ সার্ভার অপারেটিং সিস্টেমের সাথে আসে।
• LiteSpeed Web Server: এটি একটি উচ্চ পারফরম্যান্সের ওয়েব সার্ভার যা Apache-এর বিকল্প হিসেবে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।

এপ্লিকেশন সার্ভার ইন্টারফেস

ওয়েব এপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্টে বিভিন্ন ধরনের সার্ভার ইন্টারফেস ব্যবহার করা হয়:

1. WSGI (Web Server Gateway Interface)

• পাইথন ওয়েব এপ্লিকেশনের জন্য স্ট্যান্ডার্ড ইন্টারফেস
• পাইথন এপ্লিকেশন এবং ওয়েব সার্ভারের মধ্যে যোগাযোগের জন্য ব্যবহৃত
• উদাহরণ: Gunicorn, uWSGI

2. ASGI (Asynchronous Server Gateway Interface)

• WSGI-এর আধুনিক, অ্যাসিঙ্ক্রোনাস সংস্করণ
• WebSocket, HTTP/2 সাপোর্ট করে
• উদাহরণ: Uvicorn, Daphne, Hypercorn

3. Servlet

• Java-ভিত্তিক ওয়েব এপ্লিকেশনের জন্য ব্যবহৃত
• উদাহরণ: Apache Tomcat, Jetty

সার্ভার আর্কিটেকচার এবং স্কেলিং

আধুনিক ওয়েবসাইটগুলি প্রচুর ট্রাফিক পরিচালনা করতে জটিল সার্ভার আর্কিটেকচার ব্যবহার করে:

1. লোড ব্যালেন্সিং

• একাধিক সার্ভারে ট্রাফিক বিতরণ করে
• সার্ভার ফেইল হলেও ওয়েবসাইট কাজ করে
• পারফরম্যান্স বাড়ায়

2. CDN (Content Delivery Network)

• বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা সার্ভারে কন্টেন্ট স্টোর করে
• ব্যবহারকারীকে নিকটতম সার্ভার থেকে কন্টেন্ট দেয়
• লোডিং স্পিড বাড়ায়

3. ক্লাউড হোস্টিং

• AWS, Google Cloud, Microsoft Azure-এর মত প্ল্যাটফর্মে সার্ভার হোস্ট করা
• ডিমান্ড অনুযায়ী স্কেল করতে পারে
• মেইনটেন্যান্স সহজ

সার্ভার সিকিউরিটি

সার্ভার সিকিউরিটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ সার্ভারে সেনসিটিভ ডাটা থাকে:

• ফায়ারওয়াল: অননুমোদিত অ্যাক্সেস ব্লক করে
• SSL/TLS: ডাটা এনক্রিপ্ট করে (HTTPS)
• রেগুলার আপডেট: সিকিউরিটি প্যাচ ইনস্টল করে
• অ্যাক্সেস কন্ট্রোল: শুধুমাত্র অনুমোদিত ব্যক্তিদের অ্যাক্সেস দেয়

শেষ কথা

আশা করি, সার্ভার কি এবং বিশেষ করে ওয়েব সার্ভার কিভাবে আমাদের পছন্দের ওয়েবসাইটগুলোকে আমাদের স্ক্রিনে পৌঁছে দেয়, সে সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা দিতে পেরেছি। সার্ভার হলো ইন্টারনেটের নেপথ্যের নায়ক, যা ছাড়া আজকের ডিজিটাল বিশ্ব অচল। পরের বার যখন কোনো ওয়েবসাইট ভিজিট করবেন, তখন এর পেছনের এই জটিল কিন্তু অসাধারণ প্রক্রিয়াটির কথা একবার ভেবে দেখতে পারেন!